মেহেদী হাসান খান সিয়াম: এক মাসব্যাপী রমাদানের রোযা রাখার পর আনন্দের সওগাত নিয়ে ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে হাজির হয়। আল্লাহর অবারিত রহম পাওয়ার রোনাজারি মধ্য দিয়ে সিয়ামের দিনগুলো অতিবাহিত করার যে আনন্দ মুমিন হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়- ঈদুল ফিতর সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। শাওয়াল মাসের প্রথমা তিথির চাঁদ দেখার সাথে সাথেই মসজিদের মাইকে, ফোনে, টেলিভিশনে, অনলাইনে, অফলাইনে, সর্বোপরি চারিদিকে ‘ঈদ মোবারক’র বিউগল বেজে উঠে।
সন্ধ্যার পর থেকেই ‘ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ’ এ স্লোগানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। স্লোগানটি ঈদের আনন্দে আমেজ তৈরি করে, দুঃখ-গ্লানিগুলো ঢেকে রাখতে সাহস জোগায়। তবুও যে বাড়ির খোকা প্রবাসে আছে, যে বাড়ির খোকার দৈহিক অস্তিত্ব পৃথিবীতে নাই সে বাড়ির মায়ের জন্য ঈদ শুধু একরাশ আনন্দ বয়ে আনে না, সাথে নিয়ে আসে খোকার বায়না ধরার নানান স্মৃতি। খোকার স্মৃতিকথা মনে করে কিছু সময়ের জন্য সবার আড়ালে চোখের জলে বুক ভেজান মা। এরপর বাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়ের জামাই, ছেলের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের মেহমানদারী করতে যেয়ে অনিচ্ছা সত্বেও হাসি দিয়ে কান্নাটাকে আড়াল করতে হয়। এভাবে সামাজিকতার জন্য হলেও একটা সময় তিনি আনন্দে ফিরে যেতে পারেন। এটা তো গেল একটা বাড়ির মায়ের ঈদ আনন্দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত বেদনার কথা। আচ্ছা, এ মায়ের মতো একটা পুরো দেশের জন্যও ঈদ নিরেট আনন্দ নিয়ে আসে না- এমন নজির কি আছে পৃথিবীতে?
আমাদের দেশর আকাশের মতো ফিলিস্তিনের আকাশটার দিকেও কি চাঁদ অনুসন্ধানী কোনো চোখ তাকিয়ে আছে? ফিলিস্তিনের গাজার ঐ শিশুটিও কি আমার বাসার শিশুটির মতো পছন্দের জামা পরিধান করে নতুন সাজে সাজতে পেরেছে? তারা তো রোজ রক্তের রঙ্গে সেজে চলছে! তাদের এ সাজ দেখে পাহাড়ের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে, ঝড়ের গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে তবুও দানবদের দানবীয় মনের কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। এই সভ্য সমাজে এসেও ঐ শিশুগুলো আমাদের স্লোগানে গলা মিলিয়ে বলে উঠতে পারছে না ‘ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এ লজ্জা আমাদের, এ লজ্জা বিকাশমান আধুনিক পৃথিবীর!
আচ্ছা, আগের আলোচনায় আসি। ‘ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ’ এই স্লোগানে চারদিক মুখরিত করেই আমাদের মাঝে রোজার ঈদ উপস্থিত হয় । রোজার ঈদ তো একটাই, তবুও শৈশবের ঈদ আর এখনকার ঈদ কি এক?
এই প্রশ্ন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে শৈশবের ঈদের দিনগুলোতে। শৈশবে ঈদের অনেকদিন আগ থেকে বায়না ধরতাম মার্কেটে যাওয়ার জন্য। আব্বা হঠাৎ একদিন বলতেন আজকে মার্কেটে যাবো। আমরা ভাইবোন দ্রুত প্রস্তুত হয়ে যেতাম মার্কেটে যাওয়ার জন্য। মার্কেটে যেয়ে আমার যে কাপড়টা পছন্দ হতো সেটাই কেনার জন্য বায়না ধরতাম। এর চেয়ে দামি কাপড় কিনে দিলেও নাছোড় বান্দার মতো বায়না ধরতাম আমার পছন্দের কাপড়টাই কিনে দেওয়ার জন্য। অবশেষে আব্বা আমার নাছোড় অবস্থা বুঝতে পেরে আমার পছন্দের কাপড়টাই কিনে দিতেন। বাড়ি ফিরে, যা যা কিনেছি তা বন্ধু-বান্ধবকে বলতাম কিন্তু সেগুলো কাউকে দেখাতাম না, পুরাতন হয়ে যাবে বলে! এমনকি কাপড়ে ব্রান্ডের যে লগো লাগানো থাকতো তাও ছিড়তে দিতাম না।
ফরজ নামাজের পর সুন্নতী মুসল্লিরা যেমন আঙ্গুলে তাসবীহ্ গণনা করেন তেমনি তখন আমাদের ভাইবোনের শুরু হয়ে যেতে ঈদ কয়দিন বাকি সেটা গণনা করা। দাদু বাড়ির আশেপাশের চাচীদের নিয়ে পিঠা বানানোর জলসা বসিয়ে দিতেন। তা দেখে তো ভাইবোন ছাতক পাখির মতো বসে বসে ঈদের প্রহর গণনা করতাম।
ঈদের আগের দিন বিকেল থেকেই চাঁদ দেখার অপেক্ষায় থাকতাম। বেলা যেন ফুরাবার নয়! অনেক অপেক্ষার পর সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে অনুসন্ধানী চোখে আকাশের দিকে তাকাতাম। আমাদের বাড়ির পাশে বড় একটা ফাঁকা জায়গা আছে ওখান থেকে আকাশটা ভালো দেখা যায়। গাছের কারণে বাড়ি থেকে চাঁদ না দেখা গেলে দাদা-দাদু বলতেন একটু জমির দিকে যেয়ে দেখে আয় তো চাঁদ দেখা যায় কিনা? চাঁদ দেখা গেলে দাদু চাঁদ দেখার দোয়া শিখিয়ে দিতেন। সন্ধ্যার পর পাশের বাসার রুবি আপার কাছে ছুটে যেতাম হাতে মেহেদী দেওয়ানোর জন্য। রুবি আপা ব্যস্ত থাকলে অনেক্ষণ অপেক্ষা করতাম। মেহেদী না দিলে কি ঈদ হয়! যত রাতই হোক মেহেদী দিয়েই বাড়ি ফিরতাম। নির্দিষ্ট সময় পর হাত ধুয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। এদিন ফজরের আগ মুহুর্তেই আমরা ঘুম থেকে উঠে যেতাম অথচ অন্যদিনে, মক্তবে পাঠানোর জন্য সকালে আম্মা, দাদু কত যে চিল্লাচিল্লি করে ঘুম ভাঙ্গাতেন তা লিখে বুঝানো মুশকিল!
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের বাড়ির আশেপাশে যত রাস্তা আছে আমরা সেগুলো ঝাড়ু দিতাম। এরপর সূর্য উঠার সাথে সাথেই গোসলে চলে যেতাম। গোসল থেকে আসার পর দেখতাম আম্মা সেমাই, নুডলস, পিঠা রান্না করে রাখছেন। নতুন কাপড় পড়ে খাওয়া-দাওয়া শেষে দাদু কাপড়ে আতর ও চোখে সুরমা দিয়ে দিতেন। ঈদগাহে যেয়ে মজা (শিশুদের খাবার-দাবার) খাওয়ার জন্য বাড়ির সবাই কিছু টাকা সালামী দিতেন। এরপর দাদা ও আব্বার সাথে ঈদগাহে যেতাম। ঐখানে যেয়ে বন্ধুরা মিলে খাওয়া দাওয়ার উৎসবে মেতে যেতাম। নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকুলি করতাম। পরিচিতদের সাথে কোলাকুলি না করলে ভাবতাম ঈদই উৎযাপিত হবে না। তখন কে আমার সাথে কখন ঝগড়া করেছিল, কে ধনী, কে গরীব তা ভুলে সবাইকে বলতাম ‘ঈদ মোবারক’। দীর্ঘ একমাসের রোযার শিক্ষাগুলোর মধ্যে এই শিক্ষাটাও তো একটা যে, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা। জাতীয় কবিও তাঁর কালজয়ী গানে তা বলে গেছেন, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন, হাত মিলাও হাতে।’ কিন্তু, শৈশবে তো এই পুঁথিকথা জানা ছিল না। তখন তো জ্ঞানানুভূতিও তৈরি হয়নি! এজন্যই শিশুদের জন্য সামাজিক পরিবেশ বড় একটা নিয়ামক।
ঈদগাহে খুতবাহ শেষ হলে আমরা চলে যেতাম কবরস্থানের দিকে। কবর জিয়ারত করে এসে বন্ধুরা একে অপরের বাড়িতে যেতাম, কার বাড়িতে আগে নিয়ে যাওয়া হবে তা নিয়ে গোলমাল বেঁধে যেত । বিকেলে বেঁড়িবাধে নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতাম আর যাকে দেখি তাকেই বলতাম ঈদ মোবারক! কোনো কোনো সময় ঈদের পরদিন নানাবাড়িতে ঘুরতে যেতাম। এভাবে স্মরণীয় ও স্মরণহীন নানা কর্মসূচিতে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে পালন হতো আমাদের রোজার ঈদ।
এখন! এখনও কি ঈদ আনন্দ আসে? হ্যাঁ ঈদ এখনও আনন্দ নিয়ে আসে তবে তখন ঈদের আনন্দ যেগুলোতে ছিল এখন ঈদ আনন্দ সেগুলোতে নাই। রোজার ঈদ একটা হলেও তত্ত্বকথা জানার পর, জ্ঞানানুভূতি, আশা-আকাঙ্খা, হিসাব-নিকাশ বুঝার পর এখানকার ঈদ আনন্দের গতিপথটা অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। হিসাব-নিকাশের এই মস্তিষ্কে আগের মতো হাত রাঙা মেহেদী, সুন্দর জুতো ও পাঞ্জাবিতে ঈদ আনন্দ বিক্রি হয় না।
লেখক: মেহেদী হাসান খান সিয়াম, শিক্ষার্থী, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এসআই/
মন্তব্য করুন