শাকিল শাহরিয়ার: সম্প্রতি কর কর্মকর্তা মতিউরের ছাগলকাণ্ডের সূত্র ধরে আলোচনায় আসে সাদিক এগ্রো। এই সাদিক এগ্রোর আলোচনা ধরে সামনে আসে ব্রাহামা জাতের গরুর খবর। যা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তবে মাংসের জন্য বিশ্ব জুড়ে এই জাতে গরুর বেশ খ্যাতি থাকলেও বাংলাদেশে এই জাতের গরু নিষিদ্ধ।
ছাগলকাণ্ডের পর থেকে সাদিক এগ্রোর একের পর এক খামারে ব্রাহমা গরুর সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বুধবার (৩ জুলাই) দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি দল রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদিক এগ্রোর আরও একটি খামারে অভিযান চালিয়ে ৬টি ব্রাহমা জাতের গরুর সন্ধান পেয়েছে। পরবর্তীতে জানা যায় এই ব্রাহমা গরু নাকি বাংলাদেশে লালন পালন নিষিদ্ধ। চলুন জেনে নেয়া যাক ব্রাহমা গরুর পরিচিতি এবং ব্রাহমা গরু বাংলাদেশে নিষিদ্ধের পিছনের কারণ।
বিশ্বজুড়ে গবাদিপশু পালনের ক্ষেত্রে ব্রাহমা জাতের গরু দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এদের বড় আকার, শান্ত স্বভাব ও উচ্চমানের মাংসের জন্য খ্যাতি আছে। এসব কারণেই খামারি ও গরুর মাংস খেতে যারা পছন্দ করে, তাদের কাছে আকর্ষণীয় এ জাত।
সনাতন ধর্মালম্বীদের পবিত্র এবং মন্দিরের গরু বলে পরিচিত ব্রাহমা বা ব্রাহ্মণ আমাদের আজকের আলোচিত গরু। সনাতন ধর্মালম্বীদের দেবতা কৃষ্ণ এই জাতের গরুকে তার বাহন হিসাবে ব্যবহার করতেন। এই কারণেই এই গরুকে ব্রাহ্মণ গরু বলা হয়। যদিও বর্তমানে যে ব্রাহমা গরু পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা মাংসের গরু হিসাবে বেশ জনপ্রিয় সেটা আসলে ইন্ডিজেনাস বা বিশুদ্ধ ব্রাহামা জাত না। বর্তমান ব্রাহামা জেবু (বস ইন্ডিকাস) জাতের ৪/৫ টা গরুর শংকর করে উন্নয়ন করা হয়েছে একটি জাত। গড় ওজন: ব্রাহমা জাতের ষাঁড়: ৭০০-১০০০ কেজি। গাভী: ৪৫০-৬০০ কেজি। বাছুর: ২৮-৩৫ কেজি। আর কিছু ব্রাহমার ওজন আরও বেশি হয়। ব্রাহমার উচ্চতায় ১২৮ থেকে ১৪৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
ব্রাহমা জাতের গরু চামড়ার রঙের দিক থেকেও অনন্য। এদের গায়ের রং যে কারোরই চোখে পড়বে। তিনটি রঙের গরু সচরাচর দেখা যায়। এর মধ্যে একটি সোনালি রং বা ব্রোঞ্জ রং থেকে শুরু করে গাঢ় লাল পর্যন্ত। আরেকটি সাদা থেকে হালকা বা গাঢ় ধূসর রঙের। অন্যটি রূপালি রঙে জন্মগ্রহণ করে এবং ধীরে ধীরে গাঢ় কালো রঙে পরিণত হয়। এদের মাথার শিংয়ের পাশের রং, গলার নিচে ঝোলা চামড়ার রং, কুঁজের রং ও আকার চোখে পড়ার মতো। এটিও একটি এদের জনপ্রিয়তার কারণ।
ব্রাহমা জাত হলো আমেরিকায় উদ্ভাবিত একটি গরুর জাত। যা মূলত মাংস উৎপাদনের জন্য পরিচিত। ১৮৮৫ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ভারতীয় গরুর জাতের সংকরায়ণ করে এই জাতটি তৈরি করা হয়েছিল। মাংসের স্বাদের জন্যও পছন্দের শীর্ষে এরা। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় গরুর জাত।
মাংস উৎপাদনে এই নতুন সৃষ্ট ব্রাহমা গরু পুরো পৃথিবীতে খ্যাতি ছড়ালেও দুধ উৎপাদনে ঠিক বিপরীত অবস্থা। ছোট দুধ উৎপাদন কালের এই গরুর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা সন্তোষজনক না হলেও দুধের মান খুবই উন্নত। অধিক মিল্কফ্যাট এবং মিল্ক প্রোটিন বিদ্যমান থাকায় এই জাতের দুধ খুব সুস্বাদু।
পৃথিবীর মাংসের বাজার মার্কিন ব্রাহমা এবং এটা থেকে উন্নয়ন করা গরু নিয়ন্ত্রণ করে তাই অর্থনৈতিকভাবে এই গরুর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া এই জাতের গরুর মাংস সুস্বাদু হওয়ায় মাংসের বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মাংসের জন্য এই গরু পালন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে।
যেহেতু ব্রাহমা মাংসের গরু এবং মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। তাই দুধ উৎপাদনের জন্য এই গরু পালন মোটেও লাভজনক নয়। তাছাড়া এই গরু যেহেতু খোলা জায়গা ঘাস খাওয়ানোর মাধ্যমে পালন করা হয়। তাই আমাদের দেশে এই গরু পালন লাভজনক নাও হতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে ভূমি এবং গো খাদ্যের অভাব রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশে যেহেতু দুধ বিক্রি করে গরু পালনের খরচ খামারি মিটিয়ে থাকে। তাই আমাদের দেশে এই গরু পালন কতটা লাভজনক তা খামারি নিজেই অনুধাবন করতে পারবে। তাছাড়া এই গরুর রক্ষনাবেক্ষন ও কঠিন, যেহেতু এটা অবাধ্য টাইপ এর গরু। বয়ঃসন্ধির পরে এই গরুর বৃদ্ধি কমে যায়। তাছাড়া ব্রাহমা গরু প্রজননক্ষম হতে অন্য গরু অপেক্ষা অধিক সময় লাগে।
ব্রাহমা আমাদের এই উপমহাদেশেরই গরুর একটি জাত, মাংসের গুণ ও উৎপাদনের দিক দিয়ে এ জাতের গরু অনেক ভালো। জাতটি এ অঞ্চলের আবহাওয়া উপযোগী ও রোগপ্রতিরোধী। তবে ব্রাহমা জাতের গরু তার আকৃতি অনুযায়ী বেশি দুধ দেয় না। যতটা দুধ দেয়, তাতে শুধু বাছুরের চাহিদাই মেটে। খামারিরা বেশি মুনাফার আশায় যদি ব্যাপক হারে ব্রাহমা উৎপাদন করেন, তাহলে দেশে গরুর দুধের উৎপাদন কমে যেতে পারে। মূলত বাংলাদেশের দুগ্ধ উৎপাদন খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই বেসরকারি পর্যায়ে এ জাতের গরু আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ জাতের গরু বাংলাদেশে পালন ও উৎপাদন নিষিদ্ধ না হলেও ২০১৬ সালে এক নীতিমালার মাধ্যমে এ জাতকে আমদানি নিষিদ্ধের তালিকায় রাখা হয়েছে। ব্রাহমা গরু লালনপালনের ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আইনে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে নীতিমালা অনুসরণ করে লালনপালন করতে হবে।
এসআই/
মন্তব্য করুন