এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন বলেছেন, ছাত্রলীগের নেত্রী আমাকে এতটাই নির্যাতন করে ছিল যে, আমার কাছ থেকে সুইসাইড নোট লিখে নিয়ে বলে, এবার তোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখবো। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন যদি রাজনৈতিক দলের হাতে জিম্মি না থাকে, তাহলে সব শিক্ষার্থীদের জন্যই নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরি হবে।
শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এভাবেই বিগত সরকারের আমলে হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজি ফারজানা মিম, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জায়মা মুনমুন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনথিয়া মেহরিন সকাল।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা বলেন, নিবর্তনমূলক ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বিনা অপরাধে এক বছর জেল খেটেছি। কিডনি রোগ থাকা সত্ত্বেও ঢাকার একটি আদালত বারবার আমার জামিন আবেদন নাকচ করে আসছিলেন। বিনা দোষে জেল খাটার পরও আমার পক্ষে বিভাগের থেকে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। কিছু কিছু শিক্ষকের পক্ষ থেকে যে আচরণ পেয়েছি, তাতে সবচেয়ে বেদনাহত হয়েছি। জেল থেকে বের হয়ে ২০ দিনের মাথায় ভাইভা বোর্ডে যেভাবে প্রশ্ন করে হেনস্থা করা হয়েছে, সেটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে।
তিনি বলেন, আমি বেদনার কথা কাউকে বলতে না পারলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমি এমন একটি প্লাটফর্মের কথা ভাবছিলাম। শিক্ষা অধিকার সংসদকে তখনই পেয়েছি। আমি ফ্যাসিস্ট সরকার থাকতে কোন কথা বলার সাহস করি নি। এখন আমি কথা বলতে পারি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী কাজি ফারজানা মিম বলেন, আমি প্রথমে যৌন হয়রানির শিকার হই। কিন্তু অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমি উল্টো হেনস্তার শিকার হই। বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরীক্ষায় আমাকে ফেল করানো হয় এবং আমি পুনরায় প্রতিবাদ করি ও নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করি।
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জায়মা মুনমুন বলেন, গত ১৫ বছর ধরে ছাত্রলীগ হলগুলোতে দখলদারত্ব চালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো, না গেলে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন, জোরপূর্বক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করানো, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি করাসহ নানারকম ঘৃণ্য কাজ তারা করে থাকতো।
তিনি বলেন, তাদের এ ধরনের অপরাধের কারণেই শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। জুলাই বিপ্লবে মায়েরাও ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু বিপ্লব পরবর্তীতে মেয়েদের কতটা মূল্যায়ন হচ্ছে, সে বিষয়টি ভাবা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সিনথিয়া মেহরিন সকাল বলেন, ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাড়া করে ছাত্রলীগ আমার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে। আমার কানে বিকট একটা সাউন্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিচে লুটিয়ে পড়ি; তখন ভেবে নিয়েছিলাম যে মারা গিয়েছি। স্বৈরাচারের পতনে, বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে কিন্তু আমার ভোগান্তি শেষ হয়নি। মাথার আঘাতের ফল প্রতিদিন সহ্য করতে হচ্ছে। নিজের চঞ্চলতা আর ধরে রাখতে পারিনি। কথা বলতে গেলেও থেমে যেতে হয়। বেঁচে আছি এই ঢের বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, এ অনুষ্ঠানে এসে মেয়েদের যে সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার কথা আমি শুনেছি, তাতে শিক্ষক হিসেবে আমার লজ্জা হওয়া উচিত। ক্যাম্পাসের হলগুলোতে নির্যাতন হয়েছে, আমরা জানতাম, কিন্তু এতটা বিস্তারিত জানতাম না। দুঃখজনক হলো, শিক্ষক হিসেবে মেয়েরা আমাদের বলেনি। জুলাই বিপ্লবে যখন মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়, তখন আমি আমার মেয়ের কথা ভাবি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, আমাদের নারী সহযোদ্ধারা যেভাবে সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল তখনই আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। তারা যেভাবে সব বাধা ডিঙিয়ে সামনে এসেছিল এর মাধ্যমেই ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের সদস্য সচিব এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।
বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস গড়ার বিষয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, বাংলাদেশ প্রকৌশের বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মনিনুর রশিদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদী।
এসএস/
মন্তব্য করুন