বাংলাদেশে যেভাবে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে তার জন্য কোচিং ও গাইড-বই জরুরী! এই জরুরত্ব কার কার দিক থেকে কতখানি তা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
১. শিক্ষার্থীর দিক থেকে
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইগুলো শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পড়ে বুঝবে, এমনভাবে কখনো বানানো হয় না। একটা বিষয় উপস্থাপনের জন্য তার আগে-পরের আরো কি কি বিষয় বোঝানো প্রয়োজন, কোন কোন ধাপ অনুসরণ করা প্রয়োজন বা কোন ধাপের পর কোন ধাপ উপস্থাপন করা প্রয়োজন—তা এই বইগুলো তৈরীর সময় অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না। আগের ক্লাসে কোন কোন বিষয়ের কতটুকু ধারণা দেওয়া হয়েছে তার সাথে সঙ্গতি রেখে অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তী ক্লাসের বই নির্মাণ করা হয় না। বইগুলোর গায়ে সহজ, আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, মাঠপরীক্ষা ইত্যাদি কথা থাকলেও ওগুলোর অনেকটাই থাকে কথার কথা। বরং যেভাবে পাঠ উপস্থাপন করা হয় তা হয়ে থাকে অনেকখানি খাপছাড়া ও জটিল।
আর এদেশে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলেও প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলাকে একটি বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে পাঠ্যবই বানানো হয়। বহু কাল ধরেই এটা এক ধরণের সংকলন-গ্রন্থের মতো। ফলে বাংলা বই থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষাটাই ভালোভাবে শিখতে পারে না। খানিকটা শিখলেও এ থেকে অর্জিত ভাষাদক্ষতা দিয়ে তারা ক্লাসের অন্যান্য বই—গণিত, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদিসহ চৌদ্দ খান বিষয় পড়ে বোঝার মতো সক্ষম হয়ে ওঠে না। ফলে পাঠ পড়ে অর্থ না বোঝার কারণে পাঠে যে অনুশীলনগুলো দেওয়া থাকে সেটাও তারা স্বাধীনভাবে করতে পারে না। এ পরিস্থিতি থেকে তাদের অধিকাংশকেই রক্ষা করে মূলত গাইড-বই আর কোচিং।
২. শিক্ষকের দিক থেকে
স্কুলগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষক বইয়ের প্রত্যেকটি পাঠের প্রত্যেকটি অংশ বুঝিয়ে পড়ান না। যারা পড়াতে চান তারা ক্লাসের সময়ের স্বল্পতা, বহু বহু বিষয়, নানা ধরণের ছুটি, পরীক্ষা ও শীফটের জটিলতার পাশাপাশি বহু ধরণের এলোমেলো কাজের বোঝায় ভারাক্রান্ত থাকেন বলে সারা বছরে বিষয়-প্রতি খুবই কম সময় পান। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পুরো বই পড়ানোর সুযোগ থাকে না। পাশাপাশি বোর্ড বইয়ের নিত্যনতুন পাঠ উপস্থাপন রীতির সাথে অধিকাংশ শিক্ষক অভ্যস্ত হতে পারেন না। প্রশিক্ষণও তারা সেভাবে পান না, বা পেলেও তা মানসম্মত হয় না। অনেকে তা গ্রহণও করতে পারেন না। আবার যারা-বা গ্রহণ করতে পারেন তারাও তা বাস্তবায়নের উপযোগী পরিবেশ ও আয়োজন পান না। ফলে অনেকেই নিজের মতো করে যা বোঝেন বা পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করেন।
অন্যদিকে পাঠ্যবই নির্মাণ যথাযথ না হওয়ায় ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষক নিজেই সেগুলো পড়ে বুঝতে পারেন না, ফলে অনুশীলনগুলোও করতে পারেন না। এটা থেকে তাদের রক্ষা করে গাইড-বই। আবার ক্লাসে শিক্ষকের কাছ থেকে না-বোঝা বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মনেই করে যে, সে এগুলো নিজে বুঝতে পারবে না। ফলে শিক্ষকেরা ঘরে বা বাইরে কোচিং খুলে নোট-গাইড ব্যবহার করে পড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেমন সাহায্য করেন, তেমনি তার অতি নিম্ন বেতনের সাথে কিছু বাড়তি অর্থ যোগ করে জীবনকে খানিক হলেও সহজ করার সুযোগ পান।
৩. অভিভাবকের দিক থেকে
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছেলেমেয়েদের সকল বিষয় ভালোভাবে পড়াবেন-বোঝাবেন, এমনটা খুব কম অভিভাবকই এদেশে প্রত্যাশা করেন। অনেক অভিভাবক এখন মনেই করেন, এদেশে স্কুল আসলে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণের একটা দপ্তর বা প্ল্যাটফর্মের মতো। গাইড পড়ে আর কোচিং করে যদি বোর্ড পরীক্ষা দেওয়া যেতো তবে নিশ্চিতভাবে বহু অভিভাবক এখন স্কুল বাদ দিতেন। কারণ পড়ালেখার বাইরে স্কুলের প্রয়োজনীয়তার যেই কথা বলা হয়, অধিকাংশ স্কুলে সেসব খেলাধুলা বা সুস্থ সাংস্কৃতিক আয়োজন ও মেলামেশার সুযোগ আর নেই।
তাছাড়া পড়ালেখা থাকলেই না তার সাথে বাকী সেসব বিষয়ের কথা ভাবা যায়! পড়ালেখাই যদি না থাকে, তাহলে ওগুলোর কথা কোনো অভিভাবক ভাবতে পারে না! আর সে-কারণে সন্তানের স্বার্থে বা নিজের স্বার্থেই তারা স্কুল নামের প্ল্যাটফর্মে সবার ছেলেমেয়ে জড়ো করে টাকাপয়সা দিয়ে কাগজপত্র সবকিছু ঠিকঠাক রেখে সন্তানের লেখাপড়ার ভারটা ভিন্ন কারো কাছে দেওয়ার কথা ভাবেন। এ পর্যায়ে যারা পারেন তারা এই দায়িত্ব হাউজ-টিউটরের উপর দেন, আর যাদের অর্থ-বিত্ত কম বা নেই, সেই বিপুল সংখ্যক অভিভাবক গাইড-বই ও কোচিংয়ের দ্বারস্ত হন।
এক্ষেত্রে কোচিংগুলো গাইড ও বোর্ড বইয়ের সাহায্য নিয়ে বিষয়গুলো যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী মোটামুটি ভালোভাবেই পাঠ দিতে চেষ্টা করে। কারণ তারা জানে, তাদের ব্যবসায়ে রয়েছে অনেক প্রতিযোগিতা—শিক্ষার্থীর যতো ভালো রেজাল্ট ততো তাদের সম্ভাবনা। এই প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হলেও সন্তানের শিক্ষার স্বার্থে জীবন ক্ষয়ে এটাকে মেনে নেওয়াই তারা লাভজনক মনে করেন, এবং উদয়াস্ত আরো পরিশ্রম করে নিজে নিঃশেষ হয়ে হয়ে সন্তানের পথে তার লাভ ছড়াতে প্রতিদিন প্রস্তুত হন!
৪. ম্যানেজিং কমিটি বা সরকারী দলের দিক থেকে
এদেশে শিক্ষকতার যোগ্যতা নির্ধারণসহ নিয়োগ প্রক্রিয়া এমন করা হয় যাতে অযোগ্যরা টাকা বা প্রভাব থাকলে সহজেই এর সুযোগ নিতে পারেন। ম্যানেজিং কমিটি নামের সরকারী দলের নেতাগোতা বা প্রশাসনও খুব সহজেই দরদাম হেঁকে অপেক্ষাকৃত অযোগ্যকে বেছে নিতে পারেন। আর যোগ্যরাও পরিস্থিতির চাপে পড়ে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে তৈরী থাকেন, বা তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিতে বাধ্য হন।
বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া আর তার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষক মিলে কমিটি আর নেতাগোতাকে শুধু নিয়োগ-বাণিজ্যই এনে দেয় তা নয়, আরো আরো বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কারণ অযোগ্যরা যেহেতু পড়াতে পারে না, সেহেতু অনিবার্যভাবে শিক্ষার্থীদের গাইড বই এবং কোচিংয়ের প্রয়োজন হয়।
আর গাইড বইয়ের প্রকাশকদের কাছ থেকে স্কুল-কমিটিগুলো প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে। অন্যদিকে যোগ্যরাও যোগ্যতা সত্তে¡ও যেহেতু টাকা দিয়ে শিক্ষক হতে বাধ্য হন, সেহেতু যোগ্য-অযোগ্য সবারই সেই টাকা তুলে নেওয়ার একটা তাগিদ থাকে। কোচিংগুলোও আশেপাশের স্কুল-কমিটি বা প্রশাসনের সাথে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে, এবং তাদেরকে টাকা-পয়সাসহ নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসাতে ঝামেলামুক্ত থাকতে চায়।
৫. সরকারী দল, মন্ত্রণালয় বা আইনের লোকজনের দিক থেকে
যতো প্রজ্ঞাপন, যতো অধ্যাদেশ, যতো নীতি, যতো আইন, যতো নিয়ম, ততো সুবিধা সরকারী দল, প্রশাসন ও আইনের লোকজনের। এদেশে যদি বলা হয়, গাইড-কোচিং চলবে না, তার মানে হলো তাদেরটাই চলবে যারা ঠিক-ঠিক স্থানে, ঠিক-ঠিক সময়ে, ঠিক-ঠিক পরিমাণে বখরা দিয়ে যাবে।
আর যদি বলা হয় চলবে, তবে চলার জন্য নিয়মনীতি-আইনকানুন মানা না-মানার অযুহাতে একইভাবে বখরা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বখরা না দিলে নিয়মও অনিয়ম হবে, বখরা দিলে অনিয়মও নিয়ম হবে।
শুধু তা-ই নয়, সময়ের সাথে সাথে এই বখরার পরিমাণ বাড়াতে পারার উপরই নির্ভর করবে কারো ব্যবসায় টেকা বা না-টেকা। এভাবে গাইড-বই আর কোচিং সারাদেশে তাদের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার খাত!
৬. জিডিপি-র দিক থেকে (!)
গাইড-কোচিং বন্ধ হলে বাংলাদেশের প্রেসগুলোকে বছরে অন্তত ৬ মাস বসে থাকতে হবে, সারা দেশের লক্ষ লক্ষ বইয়ের দোকানের প্রায় অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যাবে, প্রেস-বাঁধাইখানার লক্ষ মানুষ কাজ হারাবে, লক্ষ লক্ষ কোচিং-শিক্ষক বেকার হবে, কাগজ উৎপাদন ব্যাহত হবে, আমদানী বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া এটা থেকে ফায়দা পাওয়া লোকজনের খানিকটা আয় কমার কারণে ব্যয়ের সুযোগও কমবে! এরকম আরো অনেক কিছু ঘটবে! দেশের জিডিপি-র উপর এর কতখানি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার হিসাব উন্নয়ন মাপনেওয়ালারা বলতে পারবেন! তবে কিছু যেহেতু পড়বে তাই জিডিপি-র স্বার্থে হলেও এটাকে মেনে নিতে হবে!!
তাহলে এ অবস্থায় করণীয় কি? উত্তর: এখনো যে গাড়লরা বুঝতে পারেন না করণীয় কি, তারাই হচ্ছেন সেই তারা, যারা এই ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্থিক বা মানসিক সুবিধার ভাগীদার, এবং এই জানোয়ারতন্ত্রের অংশ!
লেখক: রাখাল রাহা
লেখক ও সম্পাদক
আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)
মন্তব্য করুন