নূরুল আনোয়ার: আজ আহমদ ছফার একাশিতম জন্ম বার্ষিকী। উনিশ শ তেতাল্লিশ সালের জুন মাসের ত্রিশ তারিখ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেঁচে থাকলে আজ রবীন্দ্রনাথের বয়সের সমান বয়সী হতেন, কিন্তু সেটি তাঁর আয়ুতে কুলোয়নি। নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে বাঁচতে হয়েছিল, যে কারণে তাঁর সে বাঁচা সুন্দরভাবে বাঁচার মতো ছিল না। এ প্রতিকূলতাকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে গিয়ে তাঁকে মাত্র আটান্ন বছর বয়সে এ পৃথিবী থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল। এ আটান্ন বছর বয়সে তিনি বাংলাসাহিত্যকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তার জন্য দীর্ঘকাল বেঁচে না থাকলেও পাঠকের আফসোস থাকার কথা নয়। এ অল্প বয়সে সাহিত্যে তিনি যা দিয়ে গেছেন তা পাঠকের চিন্তার খোরাক যোগাতে যথেষ্ট বৈ কম নয়।
আহমদ ছফা শুধু তাঁর সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, বর্তমানে তাঁর জীবনটাও যেন পাঠকের কাছে পাঠ করার মতো একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ছোটকাল থেকে তিনি যেভাবে একজন সৎ আদর্শবান মানুষ হিসেবে তৈরি করার কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন সেটাকে যদি আমরা ঐশ্বরিক হিসেবে চিন্তা করি তা একটুও বাড়িয়ে বলার মতো মনে হয় না।
‘আহমদ ছফা’ শব্দ দুটি যেন ‘দেশপ্রেমে’র একটা প্রতিশব্দ, যেটি তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। তিনি নিজের মানসিকতাকে এমনভাবে তৈরি করে ফেলেছিলেন তাঁর কাছে যেটি সত্য তা সবসময় সত্য। সত্যের অন্বেষণ করতে করতে তিনি তাঁর গোটাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, যে কারণে নিজের স্বার্থ বা সুবিধা নেওয়ার জন্য আহমদ ছফাকে কখনও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে দেখা যায়নি। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ এত সরব ছিল যে যেটি তাঁকে কিংবদন্তীতে পরিণত করে। ফলে অল্প বয়সে ‘আহমদ ছফা’ নামটি সকলের মাঝে ভালোবাসা এবং সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হতে আরম্ভ করে। এ নামটির সুবিচার করতে গিয়ে তাঁকে সারাজীবন মরণপণ যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে।
আজ আহমদ ছফা আমাদের মাঝে নেই। তিনি ‘মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরেন নাই।’ তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁর পরিচিতিটা একজন লেখকের যেভাবে হওয়া বা পাওয়া উচিত ছিল সেটি সেভাবে হয়ে ওঠেনি। অবশ্য পরিচিতি পাওয়াটা আহমদ ছফার জন্য বড় কোনো বিষয়ও ছিল না, কাজটি তিনি সঠিকভাবে করছেন কিনা সেটাই ছিল তাঁর মুখ্য বিষয়। তিনি যে নির্মোহভাবে কাজ করে গেছেন তার সে ফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। তাঁর মারা যাবার পর থেকে যত দিন যাচ্ছে বাংলাসাহিত্যে আহমদ ছফা নামটি যেন উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠছে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের ঝড় বইছে, যেটি খুব কম লেখকের বেলায় হতে দেখা গেছে। বর্তমান তরুণসমাজ আহমদ ছফা নামটি এত সম্মান এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে আরম্ভ করেছে যেটি রীতিমতো ঈর্ষনীয়। ছফা এখন তরুণদের কাছে আইডল, যেটি সচরাচর ঘটে না। অবশ্য আহমদ ছফার বিরোধীমতের লোকের সংখ্যাও অল্প নয়, তাদের কাছে আহমদ ছফা এখনও যেন এক আতঙ্কের। বিরোধীবাদীরা তাঁকে চেপে রাখার জন্য যত রকম কলাকৌশল আছে সবগুলো তারা তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে চলেছেন, কিন্তু তার বিপরীতে তিনি যেন আরও বিধ্বংসী আগুন হয়ে জ্বলে ওঠছেন। আগুনে ফুঁ দিলে যেভাবে নিভে যাবার পরিবর্তে তার ব্যাপ্তিকে বাড়িয়ে দেয়, তেমনি আহমদ ছফাকে নিয়ে যতই নাড়াচাড়া হচ্ছে ততই আমরা ওরকম কিছু লক্ষ করছি।
দিন দিন মৃত আহমদ ছফা জীবিত আহমদ ছফার চে পাঠকের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য ওঠছেন। জীবদ্দশায় তিনি যেরকম আতঙ্কের এবং ভালোবাসার ছিলেন মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর সে ধারায় আরও বেশি বেগ পেতে আরম্ভ করেছে। দিন দিন তাঁর অনুরাগী ও অনুসারীর সংখ্যা এবং জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে সেইসঙ্গে তাঁর সাহিত্যচর্চাও বেড়ে চলেছে আশাতীতভাবে। তাঁর চিন্তাচেতনা, ভাবনা বর্তমান তরুণসমাজকে যেভাবে ভাবাতে আরম্ভ করেছে, সাহিত্যবোদ্ধারা অনেকেই এখন তা একবাক্যে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
তরুণসমাজ আহমদ ছফাকে যেভাবে ধারণ করছে, তাঁকে যেভাবে নিজেদের দিশারী হিসেবে গ্রহণ করছে বাংলাসাহিত্যের কোনো লেখকের বেলায় এমনতর তেমন দেখা যায়নি। আহমদ ছফা তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, তরুণদের মধ্যে তিনি স্বপ্ন চারিয়ে দিতেন, তরুণদেরই সকল শক্তির মূল ভাবতেন- বিষয়গুলো তাঁর লেখায় নানাভাবে এসেছে। এজন্যই যে তরুণেরা তাঁকে আপন করে নিয়েছে তা একমাত্র কারণ নয়, ব্যাপারটা অন্যত্র।
তিনি যে সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি, সর্বোপরি এদেশের মাটির কথা সুন্দর, সচেতন এবং যুক্তি দিয়ে, প্রতিবাদের ভাষায় তুলে ধরেছেন এটাই আজ তাঁকে তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। আজ আহমদ ছফাকে ভালো লাগার এবং ভালোবাসার মানুষ যেমন আছেন তেমনি সহ্য করতে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক, কিন্তু তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়, যারা আহমদ ছফাকে ভালোবাসেন এবং অন্তর থেকে গ্রহণ করেন তাদের তুলনায়। একজন মানুষ সর্বস্তরের মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারেন না, আহমদ ছফাও যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠবেন সেটাও আমরা আশা করতে পারি না, তবে যারা আহমদ ছফার মতাদর্শকে গ্রহণ বা সহ্য করতে পারেন না তা যতটুকু না যৌক্তিক তার চে বেশি মনস্তাত্ত্বিক, যে কারণে আহমদ ছফাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে যে কাউকে দশবার ভাবতে হয়।
আমাদের এখানে যারা লেখালেখিতে আসেন তারা দুভাবে কলম ধরেন। যারা সাহিত্যকে সিরিয়াসভাবে গ্রহণ করে কলম ধরেন তারা রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনটাকে নিজের করে নেন। আবার কিছু কিছু লেখক আছেন যারা সাহিত্যকে একটা বিলাসিতা অথবা অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদের সামনে লক্ষ্যটা থাকে মূলত মানুষের কাছে নিজেকে লেখক হিসেবে তুলে ধরা। এই দু ধারার লেখকদের মধ্যে আহমদ ছফা প্রথম কাতারের লেখক হলেও তিনি তার থেকে আরও এক ধাপ উপরে ছিলেন। তিনি লিখে শুধু বইয়ের পাতায় বন্দি থেকে লেখক হিসেবে অন্যের কাছে নিজেকে জাহির করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না, তিনি যা বলতেন বা লিখতেন তা তিনি করে দেখাতেও মাঠে নেমে যেতেন। একপেশে লেখক তিনি ছিলেন না, যে কারণে তাঁকে সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে তার রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখায় অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর স্বার্থের পরিপন্থী হবে জেনেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কোনোটাকে এড়িয়ে যাওয়া আহমদ ছফার স্বভাবে ছিল না। সমাজের, রাষ্ট্রের, ব্যক্তির মধ্যে যখনই তিনি কোনোরকম অসঙ্গতি লক্ষ করেছেন তখনই তিনি কলম হাতে নিয়ে বসে যেতেন। শুধু কলম হাতে নয়- মাঠে, ময়দানে, রাস্তা, ঘাটে তাঁর সরব উপস্থিতি জানান দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করতেন, কখনও কখনও নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে একাত্ম করে ফেলতেন। এখানে আহমদ ছফা অন্যলেখকদের চে একেবারে ব্যতিক্রম, মোটাদাগে এখানেই আহমদ ছফার বিশেষত্ব। সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার যে সংস্কৃতি আহমদ ছফা তৈরি করেছিলেন সেটি বর্তমান তরুণ সমাজকে খানেকটা হলেও প্রভাবিত করতে পেরেছে তা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তাছাড়া আহমদ ছফার লেখার মধ্যে যে বিনোদনের খোরাক আমরা পাই, সেই বিনোদনে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। যারা আহমদ ছফার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত তারা অবশ্যই স্বীকার করে নেবেন, আহমদ ছফার হালকা কথার মধ্যেও ভারি কথার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, যে কারণে তাঁর একটা বাক্য পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে তিনবার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। তাঁর গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ পাঠে যখন কেউ ঢুকে পড়ে তখন সেখান থেকে কারও ফুরফুরে মেজাজে বের হয়ে আসার সুযোগ থাকে না। তাঁর লেখার প্রতিটি বাক্য পড়তে গিয়ে পাঠককে ধাক্কা খেতে হয়। সে ধাক্কায় পাঠক ছিঁটকে পড়ে না গিয়ে বরং সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে যান। তখন তাদের উপর কোথা থেকে একটা অজানা শক্তি এসে ভর করে, তখন তারা আহমদ ছফার চোখ দিয়ে চিনে নেন তার দেশ-জাতির ভবিষ্যত এবং সুদূরের গন্তব্য।
এই সবকিছু মিলিয়ে আহমদ ছফা এখন সকলের কাছে প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রাসঙ্গিকতার কারণে তাঁর চিরশত্রু পাঠকটিও তাঁকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন না। কঠোর সমালোচক মানুষটিকেও তিনি কঠিন ভাবনায় ফেলে দিয়ে তাকে একরকম ঘোরের মধ্যে রেখে দেন। আহমদ ছফাকে নিয়ে এই যে ঘোরটি তৈরি হয়েছে সেটি কখনও কাটবে বলে আমাদের মনে হয় না। কারণ আহমদ ছফা তাঁর একটা দর্শনের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে গেছেন।
নূরুল আনোয়ার: লেখক, গবেষক এবং ‘আহমদ ছফা রচনাবলি’র সম্পাদক ও তাঁর জীবনীকার
এসআই/
মন্তব্য করুন