জি. কে. সাদিক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের পরই রাজধানীসহ সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও সনাতন ধর্মালম্বীদের বাড়িতে, ধর্মীয় স্থাপনা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে- জনপ্রিয় ব্র্যান্ড দল জলের গানের প্রধান ভোকালিস্ট রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুনের ঘটনা। এই ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন তৈরি করে। বিশেষ করে জলের গানের দেওয়া একটি বিবৃতি বেশ আলোড়ন তৈরি করে। বিবৃতির এক জায়গায় বলা হয়, ‘সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তাঁর নিজ ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ এই দুটি লাইন দেশে-বিদেশে মানুষের মনে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে জলের গানে আমাদের যাদের হৃদয় শীতল হয় তাদের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। রাহুল তার স্ত্রী ও ১৩ বছরের সন্তানের অসহায়, করুণ ও ভয়ার্ত মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।
বিবৃতিতে ব্যান্ডটি আরও লিখেছে, ‘তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন, তারা সকলেই খবরটি জানেন। হ্যাঁ!, রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার, এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন।’
‘তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ?’ বিবৃতির এই লাইনটায় চোখ আটকে যায়। এই লাইনেই স্পষ্ট হয় বেশ কিছু বিষয়। এক. রাহুল আনন্দের বাড়িটি হচ্ছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রবীন্দ্রসরোবরে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং এই আগুন দেওয়ার কারণ হিসেবে বিবৃতে পড়ে যা বুঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে, তার নাম রাহুল আনন্দ, তার ধর্ম পরিচয় ও তার বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে; যেখানে পাশেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও বঙ্গবন্ধু মিউজিয়া এবং রবীন্দ্রসরোবর। নামটা রবীন্দ্রসরোবর! এই কয়েকটি বিষয় মনে রাখুন তারপরের আলোচনায় যাই।
এদিকে এখন জানা যাচ্ছে যে, রাহুল আনন্দের বাড়িতে আসলে কেউ আগুন দেয়নি। বরং বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে দেওয়া আগুন তার বাড়িতেও ছড়িয়ে পরেছে। এই বিষয়টি প্রথমে সামনে আনেন রাহুল আনন্দের স্ত্রীরর বিজনেস পার্টনার ও পারিবারিক বন্ধু ফারহানা হামিদ। রাহুল আনন্দের স্ত্রী উর্মিলা শ্লকার ‘Khut- খুঁত’ নামে নারীদের পোশাক বিক্রির অনলাইন বিজনেস রয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের পার্টনার হচ্ছেন ফারহানা হাদিম। তিনি গত তিন দিন আগে তার ফেইসবুক আইডিতে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লেখেন। যেটি জলের গানের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজ থেকেও শেয়ার করা হয়েছে। পোস্টটি গত ৯ আগস্ট করা হয়েছে। ঘটনার ৪ দিন পর। ততদিনে দেশে-বিদেশে সাম্প্রদায়িকতার জল অনেক দূর গড়িয়েছে।
সেই পোস্টটির কিছু অংশ এরকম: রাহুল আনন্দের (এখানে রাহুল আনন্দকে মেনশন দেওয়া হয়েছে) বাসা উদ্দেশ্য করে আগুন দেয়া, লুটপাট বা ভাংচুর করা হয়নি। আগুন দেয়া হয়েছে ৩২-এর ‘বর্তমান বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম ও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ’ সেটুকুতে। রাহুলদা একটা একতলা বাসায় ভাড়া থাকতেন। একপাশে তাদের সংসার, অন্য পাশে জলের গানের স্টুডিও (অনেকের ভিডিওতে এই বাসাটা নিয়ে ভুলভাল কথা বলতে দেখেছি আমি)। সেই বাড়িটা ব্যক্তিমালিকানায় ছিলো। ৩২-এর সেখানে আরো অনেক এমন বাসা আছে। রাহুলদা ও তার পরিবারের দুর্ভাগ্য এই মায়াময় বাসাটা নতুন মিউজিয়ামের দেয়াল ঘেষে এবং সান্তুরের পিছনে ছিলো, তাই তার বাসাতেও আগুন দেয়া হয়।
রাহুলদাকে উদ্দেশ্য করে আগুন দিলে তারা এই পরিবারকে এভাবে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতো না। আর সুযোগ না দিলে সেই বাসা থেকে বের হওয়া অসম্ভব। রাহুলদার বাসায় আগুনের সাথে রাহুলদার ধর্ম, বর্ণ, জাত, সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এমন গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করছি।’
এই হল ঘটনা। আমি এই লেখার নিচে সেই ফেইসবুক পোস্টের লিংক দিয়ে দিবো, জলের গানের পেইজে যেটা শেয়ার দেওয়া হয়েছে সেটাসহ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গত ৫ আগস্ট আগুন লাগল রাহুল আনন্দের বাড়িতে। তারপর দেশে-বিদেশে এই ঘটনা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। জলের গানের পক্ষ থেকে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে বিবৃতিও দেয়া হল। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সাম্প্রদায়িকতার মোকড় লাগিয়ে দেওয়া হল কেন? বিবৃতিতে জলের গান কেন বলল, ‘তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ?’ এটা কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়?
ঘটনা ৫ আগস্টে। রাহুলের স্ত্রীর ব্যবসায়িক পার্টনারের মুখ খোলার আগে জলের গান কিম্বা রাহুল মিডিয়াতে নিজে কেন প্রকৃত ঘটনা জানাল না? ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়া এই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গী উত্থান বলে চালিয়ে দিল কিন্তু রাহুল তারপরও চুপ ছিল কেন? জলের গানই বা চুপ ছিল কেন এতোদিন?
গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়া পর ভারতীয় মিডিয়াগুলো ভূয়া ছবি ও ফুটেজ প্রচার করে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখাতে চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে লাখ লাখ হিন্দু ভারতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন ভয়ঙ্কর প্রচারণা ভারতের মিডিয়াগুলো যখন করছে তখন রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুনের ঘটনা তাদের প্রচারণায় তেলের খনি হয়ে জ্বালানির যোগান দিয়েছে।
অথচ রাহুল সবকিছুই জানতেন আর তিনি চুপ করে ছিলেন! একজন শিল্পীর কাছ থেকে এমনটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল? রাহুল বা তার স্ত্রী এখনও চুপ আছেন। মিডিয়ার সামনে এসে তারা বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করেননি।
রাহুল আনন্দ ও জলের গান কার না ভালো লাগে আমাদের! পুরো দেশজ উপাদানে, বাংলার খাঁটি সঙ্গীতের স্বাদ তো জলের গান আর রাহুলের কণ্ঠেই আমরা পাই। কিন্তু রাহুল কী আমাদের ছাত্র-জনতাকে ধারণ করলেন? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের মোড়ক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কাজ রাহুল বা জলের গান কীভাবে করতে পারলেন? রাহুলও কি সাম্প্রদায়িকতার আগুনে আলু পোড়া খাইলেন? এই লজ্জা আমরা কই রাখি!
যুক্তি আসতে পারে যে রাহুল আনন্দ এখন মানসিকভাবে ভালো নেই তাই তিনি এখনো বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না। কিন্তু তিনি সত্য বিষয়টি তুলে ধরতে না পারলেও ঘটনার পর দিন থেকে বিভিন্ন মিডিয়াতে ভিক্টিম রোল প্লে করা শুরু করেছেন। গত ৬ আগস্ট রাতে দৈনিক প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান রাহুল আনন্দ। তিনি লিখেছেন, ‘তবু শান্তি আসুক আমার সোনার দেশে, যেকোনো মূল্যে। সে মূল্য যদি হয় আমার সোনার সংসারের পোড়া ছাই অথবা বাদ্যযন্ত্র পোড়া কয়লার বিনিময়ে, তাতেও দুঃখ নেই। ভালোবাসি বাংলা আর বাংলার মানুষকে, আমি বাংলায় গান গাই।’ জলের গানের এই সংগীতশিল্পীর চাওয়া, ‘সবার ভালো হোক। ভালো থাকুক আমার বাংলাদেশ।’
রাহুল আনন্দের ভাষ্যে, ‘কথা বলার মতো স্বাভাবিক নই আমি। প্রায় তিন হাজার বাদ্যযন্ত্র পুড়ে ছাই। ওরা আমার সন্তানের মতো। আমি একটা মানুষ বাচ্চাকে জীবিত নিয়ে বের হতে পেরেছি। বাকিরা পুড়েছে বা লুট হয়েছে।’
শেষ করতে চাই উর্দু সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ‘চ্যালেঞ্জ’ গল্পটি দিয়ে- ‘আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো। কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপর সাইনবোর্ড তখনও পড়া যাচ্ছিল, “এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।”’ (সিয়াহ হাশিয়ে/ সাদত হাসান মান্টো)
সূত্র:
১. ফারহানা হামিদের ফেইসবুক পোস্টটি পড়ুন এই লিংকে
২. প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ুন এখানে
লেখক: জি. কে. সাদিক
সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট
মন্তব্য করুন