এডুকেশন টাইমস
২৪ এপ্রিল ২০২৪, ৭:০৬ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১১ বছর: বিচারকার্যের নেই অগ্রগতি

ছবি সংগৃহীত

শাকিল শাহরিয়ার: দেশের পোশাক শিল্পে ঘটে যাওয়া সব থেকে বড় ট্রাজেডি রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর আজ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্ম দেয় রানা প্লাজা ট্রাজেডি। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন, আহত হন ১ হাজার ৫২৪ জন। তবে অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ সময় পার হলেও শ্রমিকদের মেলেনি যথাযথ ক্ষতিপূরণ, হয়নি বিচার।

রানা প্লাজা ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ভবনটি ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে ডেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর হেলে পরে। এ দূর্ঘটনায় ১১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভবনটিতে পোশাক কারখানা, একটি ব্যাংক এবং একাধিক অন্যান্য দোকান ছিল, সকালে ব্যস্ত সময়ে এই ধসের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল।

ভবনটি রানা প্লাজা হিসেবে পরিচিত এবং এর মালিক সোহেল রানা সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই নয়তলা রানা প্লাজা ভবনটি। এতে ভূগর্ভস্থ তলায় গাড়ি রাখার জায়গা ছিল। দ্বিতীয় তলার বিপণিকেন্দ্রে বহু দোকান ছিল। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা। এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল প্রথম তলায়।

গার্মেন্টস কারখানায় প্রায় ৫ হাজারের মত কর্মী কাজ করত। ২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত ডোবা। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রধান আলী আহমেদ খান, জানান যে ভবনের উপরের চার তলা অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল।

২৩ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর ভবন ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে সত্ত্বেও, অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরের দিন কাজে ফিরতে বলা হয়, তাদের সুপারভাইজার ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে।

৯ তলা ভবনটি সকাল ৯টার দিকে প্রথম তলা বাদে বাকি সবগুলি তলা ধসে পড়ে। ধসে পড়ার সময় ভবনটিকে প্রায় ৩ হাজার কর্মী ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল নয়টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দ এবং কাঁপনে তারা ভূমিকম্পের আশঙ্কা করেন। পরে বেরিয়ে দেখেন বিরাট এলাকা ধুলা বলিতে ধোঁয়াটে হয়ে পড়েছে। ঐ সময় ভবনে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল নারী যাদের সাথের তাদের শিশু সন্তানও সেখানে নার্সারী সুবিধায় ছিল।

দুর্ঘটনার পর জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে নেমেছিল ছাত্র, পোশাক কারখানার শ্রমিক, মুদি দোকানীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। খবর শোনামাত্র ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দমকল বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। তবে সেনাবাহিনী ও দমকল বাহিনীর কর্মীরাই উদ্ধার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দমকলের ২০০ জন কর্মী ও ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধার কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। ২৮ তারিখ থেকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যন্ত্রনির্ভর উদ্ধার কাজ শুরু হয়। ঘটনার ১৭তম দিনে জীবিত উদ্ধার করা হয় রেশমা আক্তারনামে একজন গার্মেন্টস কর্মীকে। ১২ মে পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়।

২৫ শে এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন ও ঐ ভবনের গার্মেন্টস মালিকদেরকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে সরকারিভাবে আলাদা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদের সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবার আহ্বান করা হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় দায়ীদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ২৭ শে এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সাভার পৌরসভার দু’জন প্রকৌশলীকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। ২৮ শে এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের ঢাকায় রানা প্লাজা ধসের দশকের বেশি হয়ে গেলেও এখনো মামলার বিচার কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতায় নিহতের পরিবার ও আহতরা তাদের জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার পাবেন কী না তা নিয়েই সংশয়ে আছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলোকে এতো বছরেও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। আহতদের পুনর্বাসন হয়নি।

শ্রমিকদের দাবি, তাদের বেশিরভাগ কাজে ফিরতে না পারায় অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যদিও বিজিএমইএ বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন বাবদ সব ধরণের সহায়তাই দেয়া হয়েছে।

রানা প্লাজা ধসে হতাহতের ঘটনায় সব মিলিয়ে ১৪টি মামলা দায়ের হওয়ার কথা জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এর মধ্যে রয়েছে, অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের হত্যা মামলা, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের করা মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলা।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়। এরমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

২০১৮ সালের ২৯ মার্চ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।

এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা চলমান আছে। তবে ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই।

২০১৬ সালে ১৮ জুলাই হওয়া মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এদিন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে দীর্ঘদিন আটকে ছিল বিচারকাজ। পরে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। মামলাটির মোট সাক্ষী ৫৯৪ জন।

এর আগে, ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকি আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৩২ জন, পলাতক ছয়জন এবং মারা গেছেন দুইজন।

রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক জরিপে বলা হয়, দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ ২০১৯ সালে বেকার ছিলেন। ২০২০ সালে করোনাকালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ, যা আগের ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরমধ্যে আহত পোশাক শ্রমিকদের সাড়ে ৯ শতাংশের কোনো আয় নেই। আর সাড়ে ১০ শতাংশের আয় ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে।

জরিপের ফলাফলে আরও বলা হয়, রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের মধ্যে ৯২ শতাংশই করোনাকালে সরকারের কোনো সহায়তা পাননি। মাত্র ৮ শতাংশ শ্রমিক অল্প কিছু সহায়তা পান। এছাড়া ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। সাড়ে ১২ শতাংশ শ্রমিক মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন। ২০১৯ সালেও এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। এর মানে ২ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।

ওই প্রতিবেদন প্রাকাশের দুই বছর পরেও শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন নেই। বিচার না পাওয়ার পাশাপাশি যথার্থ সহায়তা না পাওয়ায় বেশরিভাগ শ্রমিক এখনও দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

কিছু লোভী ও স্বার্থান্বেষী মহলের সম্পদের পাহাড় গড়ার মোহের কারণে জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের। রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা অসংখ্য পরিবারকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এগুলোর ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। শুধু সম্পদ আহরণ নয় শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও মালিকদের নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শাকিল শাহরিয়ার

শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এসআই/

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সকল টিভি চ্যানেলে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র প্রচারের উদ্যোগ 

নিটল মটরস লিমিটেডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ

এইচএসসি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করছে ইমদাদ-সিতারা খান ফাউন্ডেশন

পুতিনের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুঁশিয়ারি  

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তীব্র প্রতিরোধে শেখ হাসিনার বিদায় ত্বরান্বিত হয়: প্রেস সচিব

সিওয়াইবি জবি শাখার নেতৃত্বে ইস্রাফিল ও লাভলু

টাইমস হায়ার এডুকেশন র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশে ২য় স্থানে চবি

কুবিতে সিওইউ সাইক্লিস্টের নতুন নেতৃত্বে মামুন- রাকিন

শিক্ষা ও গবেষণায় সৌদি ফাউন্ডেশনের বৃত্তি, দেবে ৬০ লক্ষাধিক টাকা

ক্যান্টিনের খাবারের দাম এবং মান নিয়ে অস্বস্তিতে বুটেক্স শিক্ষার্থীরা

১০

শাবিতে মাস্টারমাইন্ড ২.০ শীর্ষক ‘ন্যাশনাল কেস কম্পিটিশন’ উদ্বোধন

১১

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পাটাতনের নেতৃত্বে মাসুম-সায়েম

১২

শাবিতে গণহত্যায় অর্জিত স্বাধীনতা শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী

১৩

এডিবি থেকে ৪০ কোটি ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ

১৪

বিশ্বের ৫ দেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশিদের জন্য সতর্কতা

১৫

ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে বিকাশ

১৬

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের অনুমোদন পাকিস্তান সরকারের

১৭

গণ-অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন: শফিকুল আলম 

১৮

৪৬ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাপ্তি, প্রত্যাশা ও সংকট

১৯

বাকৃবির ফজলুল হক হলে তিন দিনের ফিস্টে উৎসবের আমেজ

২০