হিলাল ফয়েজী:
আমাদের সময় ‘বুয়েট’ পরিচিতি ছিল না। ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’ উত্তরণে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তাৎক্ষণিক ‘বুয়েট’ পালক ধারণ করেনি। আমরা বলতাম ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি’। পরে জানতে থাকলাম, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ‘বুয়েট’ পরিচিতিতে সমুজ্জ্বল। এক সময় আরও জানলাম, দেশের প্রধানতম ‘মেধাকুঞ্জ’ হচ্ছে বুয়েট। ব্যক্তিগতভাবে এই ‘মেধাকুঞ্জ’ অভিধার সঙ্গে একমত নই। ‘বিশেষজ্ঞ’ আর ‘মেধাবী’ এক নয়। পাটিগণিত-জ্যামিতি-ত্রিকোণমিতিতে কাঁচা হলেই কেউ মেধাবী নন– জ্ঞান পরিমাপের বিজ্ঞান এ কথা বলে না।
পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভে বাংলাদেশ প্রসবের তীব্র বেদনা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রচ্ছদপটে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিন্টারল্যান্ডে। পশ্চাদ্ভূমির ভূমিকা যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা অবহিত মহল ভালো জানে। মোহাম্মদ ফরহাদ, সিরাজুল আলম খান, কাজী জাফর আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, পংকজ ভট্টাচার্য, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকসহ এক ঝাঁক ষাটের দশকের ধ্রুবতারা বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে মিলিত হয়ে কর্মপরিকল্পনার সূত্রবদ্ধ আয়োজন করতেন গভীর রাতে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঃসাহসী শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল উলা স্বীয় আবাসন থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ সকালে জগন্নাথ হলের জেনোসাইডের ভিডিও, ছবি তুলেছিলেন, যা একমাত্র প্রত্যক্ষ ডকুমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধে বুয়েট শিক্ষক ড. মিজানুল হক সরাসরি সশস্ত্র অংশী ছিলেন। বুয়েটের বহু ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। বহু ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। একই সঙ্গে এটাও নিষ্ঠুর সত্য– ১৯৭১ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকেও ক্যারিয়ার ‘অটুট’ রাখার দোলাচলে ক্লাস করতেন। এটি কঠিন বাস্তবতা।
স্বাধীন দেশে বুয়েট ছিল বিদ্রোহী ‘জাসদ’-এর প্রধান কেন্দ্র। জাসদ ছাত্রলীগের অনন্য মেধাবী ‘নিখিল’ ছিলেন একদিকে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অন্যদিকে ‘নিখিল বোমা’র নির্মাতা। সেই বোমার অসাবধানী বিস্ফোরণেই প্রাণ হারালেন ঢাকা মেডিকেলে। ১৯৭১ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বদিউল-বুলবুল-দুলাল’ ইসলামী ছাত্র সংঘের (শিবিরের পূর্বতন নাম) গড়া আলবদরের হিংস্র শিকার। সেই বুয়েট আজ পড়েছে এক কঠিন সংকটে। এ সংকটের সমাধানে বাজারে নানা ওষুধের কথা চলছে। কিন্তু অসুখের মূলে যেতে কেন যেন অনীহা আমাদের!
না হে বন্ধুগণ, অন্ধ ছাত্রলীগ-বিরোধিতায় এর সমাধান পাবেন না। এসব কিছুর উৎস-গভীরতা বুয়েটে নয়, অন্য কোনোখানে। এ সমস্যার সমাধানও বুয়েট পৃথক করে দিতে পারবে না। এখন চলছে বুয়েটের ছাত্রলীগ পরীক্ষা, আর ছাত্রলীগের বুয়েট পরীক্ষা। এ পরীক্ষার ফলাফল কী হবে? বাস্তবতা হচ্ছে– পাস করতে হবে দু’পক্ষকেই।
সমস্যাটির সূত্র খুঁজতে যেতে হবে ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক ভারতবর্ষ ভাগে। আমরা পূর্ব বাংলার মুসলমান ‘পাকিস্তান’-এর পক্ষে ১৯৪৬ সালে ভোট দিয়েছি। বর্তমান পাকিস্তানের লোকেরা ‘পাকিস্তান’ চায়নি। গণভোটে সেখানে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাবনা হেরে গিয়েছিল। তবুও উপমহাদেশ ভারত-পাকিস্তানে বিভক্ত হলো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা গেল এলিট জমিদার, সেনা, আমলা ও ক্ষমতাদর্পী মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে। পূর্ব পাকিস্তানে শুরু থেকেই এলিট মুসলিম লীগ বনাম সাধারণ মুসলিম লীগের মাঝে তীব্র দ্বন্দ্ব। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এলিটরা নাকানি-চুবানি খেল। ষাটের দশক শুরুর আগে আগে এলিটদের পক্ষে মাঠে সরাসরি নামল ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। নন-এলিটদের ক্রমাগত জাগরণের অগ্রভাগে শেখ মুজিব, পরে যিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। গণরায়ে পাকিস্তানের প্রধান জননায়ক বঙ্গবন্ধু। ক্ষমতায় তখন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া। ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং সে রায় অগ্রাহ্য করতেই দুনিয়া কাঁপানো গণবিক্ষোভের পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা। ইতিহাসের এ অংশটুকু না মানলে আপনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। বুয়েট কেন; কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র হওয়ার যোগ্য নন।
নবজাত বাংলাদেশকে মানতে পারলেন না হেনরি কিসিঞ্জার। বঙ্গবন্ধুকে মানবেতিহাসের এক নৃশংস ষড়যন্ত্রে সপরিবারে হত্যা করা হলো। বাংলাদেশের নবগঠিত সেনাবাহিনীর ভেতর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাইরাস প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল– সিভিল শক্তি নয়, সেনাবাহিনীই দেশ চালাবে। পরাজিত এলিট মুসলিম লীগ, তদানীন্তন চীনপন্থি রাজনীতিবিদদের নিয়ে জেনারেল জিয়া গড়লেন নন-এলিট অধ্যুষিত আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার এক সিআইএ ডকট্রিন ম্যানুয়ালের বাস্তবায়নকারী শক্তি। সেনাবাহিনীর অন্তর্কলহে সংঘটিত জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসে জেনারেল এরশাদ মূলত জিয়ার ধারাবাহিকতায় দেশ চালান।
জিয়ার হাতিয়ার হলো ছাত্রদল। সেনা-দুর্গ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মুস্তাফিজ পাঠালেন অস্ত্র; উপ-উপাচার্যের বাসভবনে সে অস্ত্র নিরাপদে জমা হলো। গেস্ট রুম কালচার, নির্যাতন, মিছিলে জোর করে নেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হলো। এরশাদ ক্ষমতা নেওয়ার ক’দিনের মধ্যেই জিয়াউদ্দিন বাবলু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পতাকা ফেলে পল্লিবন্ধুর চ্যালা হয়ে গেলেন সপরিবারে। এরশাদ গেলেন। খালেদা এলেন। ছাত্রদলের পুনঃরাজত্ব। গেস্ট রুম। টর্চার। রাজনীতিতে টাকার খেলা। সেনা-দুর্গের টাকা ও অস্ত্র ছড়ানোর লীলানাট্য।
অনেক কূটনৈতিক কৌশল ও গণআন্দোলনের মিলিত ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান দল আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলো। এর পর ২০০১-এ আবার এলো বিএনপি। ২০০৪-এ হাসিনাবধের ভয়ংকর কাণ্ড ঘটল। এলো এক-এগারো। অতঃপর আবারও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। তবে সিভিল রাজনীতি দূষিতকরণের প্রক্রিয়া সেই যে শুরু হলো, তা আর বন্ধ হলো না। ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধের মহিমা থেকে চ্যুত হয়ে সেনা-দুর্গে প্রতিপালিত বিএনপি-ছাত্রদলের অপসংস্কৃতি ও হিংস্রতার নবসংস্করণে হারাতে থাকল সব সুকীর্তির ঐতিহ্য। বুয়েটে ‘আবরার হত্যা’, টর্চার সেল, নৃশংসতা প্রভৃতি তারই ফল। এসবের প্রধান শিকার হলো মুক্তিযুদ্ধের সদর্থক আবেদন।
এখন বল ছাত্রলীগের কোর্টে। গ্রহণযোগ্যতার কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে বুয়েটের মতো বাংলাদেশের জনগণ এবং ছাত্রসমাজের কাছেও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যেতে হবে তাদের। একই সঙ্গে বিরাজনীতিকীকরণের ফাঁকে বুয়েটের সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি শক্তির নীরব আস্তানায় পরিণত হওয়ার বিষয়টি বিস্তৃত হয়ে পড়বে দেশজুড়ে।
হিলাল ফয়েজী: প্রধান সমন্বয়ক, আমরা একাত্তর; ইউকসুর জিএস (১৯৭২-৭৩)
(লেখাটি দৈনিক সমকাল থেকে নেয়া।)
মন্তব্য করুন