ড. কামরুল হাসান মামুন: ছাত্র রাজনীতি নাই বলেই নাকি তলে তলে বুয়েটে উগ্র ধর্মীয় গুষ্টির রাজনীতি বেড়ে যাচ্ছে। বুয়েট আর মিলিটারি নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ছাত্র রাজনীতি আছে। এমনকি রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেও খুব ভালোভাবেই ছাত্র রাজনীতি সক্রিয়। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে? সব ছাত্র সংগঠন কী ওসব জায়গায় গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করতে পারছে এবং নেতৃত্ব শিখছে? সেইসব প্রতিষ্ঠানে কী অন্যায়ের প্রতিবাদ হচ্ছে? সেখানে কী উগ্র ধর্মীয় গুষ্টির রাজনীতি বন্ধ আছে? বাংলাদেশে এখন এমন একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে যেই দল ক্ষমতায় সেই দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি করতে পাড়ার নামই হলো ছাত্র রাজনীতি। আমি তো কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন ব্যাতীত অন্য কাউকে ছাত্রদের দ্বারা, ছাত্রদের জন্য, ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করতে দেখি না। একমাত্র তাদেরকেই দেখি নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করতে, শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি করতে, ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি করতে, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি করতে। আবার বাম দলের কোনো একটি দল ক্ষমতায় গেলে তাদের আচরণ কেমন হবে সেটাও অজানা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবশ্যই ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে। তবে যদি সেটা হয় ছাত্রদের জন্য রাজনীতি। যদি সেটা হয় ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনীতি। যদি সেটা হয় শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের শিক্ষার মানের উন্নতির জন্য রাজনীতি। ইংল্যান্ডে যারা কনসার্ভেটিভ কিংবা লেবার পার্টির ছাত্র সংগঠন করে তারা নতুন ছাত্রদের এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। প্রথমবারের মত ক্যাম্পাসে আসলে কী কী সমস্যা হতে পারে সেইসব সমস্যার সমাধানের রাজনীতি করে, তাদের আবাসিক ব্যবস্থা করে দেয়। তারা তো গেস্ট রুমে নিয়ে টর্চার করে না। তারা তো জোর করে মিছিলে নিয়ে যায় না। তারা তো জোর করে সম্মান আদায় করে না। তারা তো শিক্ষার ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রোগ্রাম দেয় না। ক্লাস চলাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসে দুই মাইল ব্যাপী মাইক লাগিয়ে প্রোগ্রাম করে ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করে না। ছাত্র রাজনীতি যদি ভালো কোনো উদাহরণ রাখতো অবশ্যই ছাত্র রাজনীতি চালু করার জন্য আমি দাবি জানাতাম। ছাত্র রাজনীতির কুফল শিক্ষক হিসাবে আমরা শিক্ষক ছাড়া কেউ বুঝবে না। ছাত্রনেতারা বছরের পর বছর ফেল করবে। তারপর পুনঃভর্তি হবে, বার বার পরীক্ষা দিবে, তার জন্য বার বার প্রশ্ন করতে হবে, পরীক্ষা নিতে হবে, নিয়মে যতগুলো পরীক্ষা দেওয়া যায় দিয়ে এরপর স্পেশাল পারমিশন নিয়ে আবার বারবার পরীক্ষা দেওয়া। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের কত কর্মঘণ্টার অপচয় হয় জানেন?
গত বছর সরকার যখন শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে যখন জিডিপির মাত্র ১.৭৬৮% দিল তখন একটি ছাত্র সংগঠনকে দেখলাম আনন্দ মিছিল করতে। কী দুঃখজনক! এর নাম কী ছাত্র রাজনীতি? ছাত্ররা ৪ জনের জন্য তৈরি রুমে ৪০ জন থেকে অমানবিক কষ্ট বরণ করছে আর এইদিকে বরাদ্দ কমালে আনন্দ মিছিল হয়। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে বেশি ছিল। এখন সেটা কমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ। এর ফলে শিক্ষকদের বিশাল একটি অংশ পার্ট-টাইম অন্যত্র পড়ায়। এতে ছাত্ররা শিক্ষকদের কাছ থেকে তাদের সেরাটা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে তার প্রায় সমান সাইজের আরো ৭টি কলেজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে এইটা নিয়েতো কোনো আলোচনা দেখি না।
তলে তলে অন্ধকারের রাজনীতি ঢুকে কারণ আমাদের দেশে ক্ষমতা কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি হয়। তারা তাদের দলের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে রাজনীতি করে না। নিজের দল ক্ষমতায় থাকা মানে যেন তাদেরকে সকল অন্যায় থেকে পার পেয়ে যাওয়ার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এরা তখন বেপরোয়া হয়ে পরে। অথচ তলে তলের অন্ধকারের যেই রাজনীতি ছড়ায় তাকে বন্ধ করতে দরকার ক্যাম্পাসে অধিকতর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড আর খেলাধুলার প্রসার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেও রাজনীতি সম্ভব এবং এসবই হওয়া উচিত ছাত্রদের দ্বারা, ছাত্রদের জন্য ছাত্র রাজনীতি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ফাউ খাওয়া, ছাত্র হয়ে ছাত্রদের টর্চার ইত্যাদি চলবে আর সেই রাজনীতি খোলার জন্য আমাদের মায়াকান্না দেখাতে হবে? লেখাপড়া করার বয়সে ক্ষমতা আর সম্পদের সাধ পেয়ে গেলে অল্প বয়সেই মানুষ পঁচে যায়। তার দ্বারা আর দেশের মঙ্গল হয় না বরং দেশকে কিভাবে লুটেপুটে খেয়ে দেশকে সর্বনাশ করা যায় সেই রাজনীতি শিখে। আমার কথা সহজ কথা। তলে তলে কিংবা উপরে উপরে সকল প্রকার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হউক। ছাত্ররা করবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং এর মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব শিখবে।
যার সন্তান যেই প্রতিষ্ঠানে পড়ে তাকে জিজ্ঞেস করুন তিনি তার সন্তানের প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি চায় কি না। পারলে অভিবাবকদের জড়ো করে দেখান যে তারা ছাত্র রাজনীতি চায়। পারলে ছাত্রদের মধ্যে একটা ভোটাভোটি নেন যে তারা তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চায় কি না। বুয়েটের ছাত্রদের আন্দোলনই প্রমাণ করে তারা চায় না। জিজ্ঞেস করুন শিক্ষকরা চায় কিনা । ছাত্র রাজনীতি থাকলে শিক্ষকদের পক্ষে বিশেষ করে প্রশাসনের পক্ষে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পারে, আবাসিক হল চালানো কঠিন হয়ে পরে। ছাত্র রাজনীতি না থাকলে বিদেশের মত দুইয়েকজন কর্মকর্তা ও ছাত্রদের দিয়েই হল পরিচালনা সম্ভব হতো। তাতে শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা বেঁচে যেত যা অন্য ভালো কাজে ব্যবহার করা যেত।
লেখক: ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসআই/
মন্তব্য করুন