ড. কামরুল হাসান মামুন: বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অনেককেই বলতে শুনি শিক্ষা মানেই কিছু করে খাওয়ার স্কিল অর্জন। লেখাপড়ার উদ্দেশ্যের একটা উদ্দেশ্য হলো কিছু করে খাওয়ার স্কিল অর্জন। কিন্তু এইটা একটি দেশের মূল ধারার শিক্ষার উদ্দেশ্য না। স্কিল অর্জনের জন্য মূল ধারার একটি শাখা ধারা সারা বিশ্বেই প্রচলিত আছে। এটিকে আমরা কারিগরি ধারা বলি। একটি দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকেই এই ধারায় শিক্ষিত করতে হয়। এর জন্য কারিগরি ধারাকে শক্তিশালী করতে হয়। মূল ধারার উচ্চ শিক্ষা সকলের দরকার নেই। মূল ধারার শিক্ষার উদ্দেশ্য দেশের বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, অর্থিনীতিবিদ ইত্যাদি তৈরি করা।
আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষাকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেই জন্যই দেশে সত্যিকারের কোনো স্কিলড কর্মী নাই। অথচ উন্নত দেশে কেউ নাপিত হতে গেলেও তাকে সেই বিষয়ে পড়াশুনা করে হতে হয়। তেমনি প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিসিয়ান, কামার, কুমোর, তাঁতী সব কাজের জন্যই লেখাপড়া দরকার আর সেই লেখাপড়াটি শিখতে হয় কারিগরি ধারায়।
এই ধারাটি আমাদের শক্তিশালী না হওয়ায় আমাদের কর্মীরা যখন বিদেশে যায় তারা কেবল ইট ভাঙ্গা অথবা কুলি, মুটে হতে পারে যাদের বেতন খুব কম। নেপাল শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে কম কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে বা মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে আমাদের চেয়ে বেশি আয় করে।
যেহেতু আমাদের কারিগরি ধারা শক্তিশালী না সেহেতু অধিকাংশ মানুষই মূল ধারাতে থেকে যায়। সবাই অনার্স মাস্টার্স করতে চায়। এত মানুষকে অনার্স মাস্টার্স পড়ানোর মত বিশ্ববিদ্যালয় নাই বলে আমরা কলেজগুলোকে অনার্স মাস্টার্স পড়ানোর পারমিশন দিয়ে দিলাম। এতে কি হলো? চিনি আছে ১০ গ্লাস শরবত বানানোর কিন্তু মেহমান হয়ে গেছে ১০০ জন। তাই চিনির ব্যবস্থা না করে ১০ গ্লাস শরবতে কেবল পানি ১০০ গ্লাস শরবত বানিয়ে ফেললাম। এই ১০০ গ্লাস শরবত যেমন আসলে শরবত না তেমনি আমাদের অধিকাংশ অনার্স মাস্টার্সও আসলে কাগুজে অনার্স মাস্টার্স।
এই ক্ষতিটা করছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের শিক্ষাকে Dilute করে। এইবার নতুন শিক্ষাক্রমকেই কারিগরি লেভেলে নামিয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষাকেও Dilute করে ফেলা হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমের যারা জনক তারা খুব খোলামেলাভাবেই বলছে যে, যারা স্কুল বা কলেজ শেষে যে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ঝরে যায় তারা ঝরে গিয়েও যেন কিছু করে খেতে পারে তার জন্যই এই শিক্ষাক্রম। তার জন্যই জীবন ও জীবিকা নামক বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তার জন্যই বিজ্ঞান শেখানোর আগেই তথ্য ও প্রযুক্তি নামক বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তার জন্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নামক বিষয় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব বিষয়ের জন্য স্থান তৈরি করতে উচ্চতর গণিত বাদ দেওয়া হলো, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের ব্যাপ্তি কমানো হলো।
তাহলে কি দাঁড়াল? একটি দেশের শিক্ষার ফোকাসটা চলে গেছে সেই ঝরে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দিকে। যারা ঝরে যাবে না তাদেরকে ফোকাস করে এই শিক্ষাক্রম তৈরি হয়নি। অথচ একই দেশের উচ্চবিত্তের সন্তানরা কিন্তু এর দ্বারা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তাদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম আগের মতোই ব্রিটিশ কারিকুলামে পড়বে। তাহলে এই দুই ধারায় পড়ুয়ারা যদি কোথাও একত্রিত হয় কেমন করে তারা সমান ভাববে?
এই দুর্বল কারিগরি মার্কা শিক্ষাক্রম পড়ে তারা কিভাবে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে ভালো করবে? কিভাবে তারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য SAT পরীক্ষায় ভালো করবে? কিভাবে তারা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোপ করবে? এই যে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে দেশের এত বড় ক্ষতি করে ফেলা হচ্ছে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কেউ প্রতিবাদ করছে? এত স্বার্থপর বুদ্ধিজীবীর দল থাকলে দেশের কোন উন্নতি হওয়া সম্ভব না।
লেখক: ড. কামরুল হাসান মামুন অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসআই/
মন্তব্য করুন